জাবি প্রতিনিধি: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের হামলার ভয়ে উপাচার্যের বাসভবনের ভেতরে আশ্রয় নিয়েছিলেন কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী শতাধিক শিক্ষার্থী। সেখানে ঢুকে তাদের মারধর করেছেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। পরে বিভিন্ন হল থেকে কয়েকশ শিক্ষার্থী বেরিয়ে এসে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের ধাওয়া দিলে তাঁরা পালিয়ে যান। সোমবার দিবাগত রাত সোয়া দুইটার দিকে এই ঘটনা ঘটে।
এর আগে রাত ১২টার দিকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের বাসভবনের ভেতরে আশ্রয় নেওয়ার ১০ মিনিট পর তাদের ওপর হামলা করে বহিরাগতসহ শাখা ছাত্রলীগের ছাত্রলীগের দেড় শতাধিক নেতাকর্মী। হামলাকারীরা উপাচার্যের বাসভবনের প্রাচীরের মূল ফটকের বাইরে থেকে আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে কাঁচের বোতল ও ইটপাটকেল ছুঁড়তে থাকে বলে অভিযোগ করেছেন শিক্ষার্থীরা। এসময় হামলাকারীদের অধিকাংশের মাথায় হেলমেট ও হাতে ধারালো অস্ত্র ছিল। এ সময় তাদেরকে পেট্রোলবোমাও ছুঁড়তে দেখা যায়।
রাত সোয়া ১২টার দিকে ঘটনাস্থলে পুলিশ আসলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা উপাচার্যের বাসভবনের প্রধান ফটক ছেড়ে রাস্তায় চলে যান। পরে রাত পৌনে একটার দিকে পুলিশের সামনে ফটক ভেঙে বাসভবনের ভেতরে প্রবেশ করেন হামলাকারীরা। এ সময় বেশ কয়েকটি পেট্রলবোমা ছুড়ে বাসভবনের প্রধান ফটকের লাইটসহ বিভিন্ন লাইট ভাঙচুর করেন তারা। এরপর আন্দোলনকারীদের ব্যাপক মারধর করেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এ সময় উপাচার্য বাসভবনেই ছিলেন। হামলাকারীরা পুলিশের উপস্থিতিতে আন্দোলনকারীদের উপর হামলা চালালেও পুলিশ তাদেরকে বাধা দেয়নি বলে অভিযোগ করেছেন শিক্ষার্থীরা।
রাত সোয়া একটার দিকে উপাচার্যের বাসভবনের ভেতরে আশ্রয় নেওয়া একজন শিক্ষার্থী ফেসবুক লাইভে গিয়ে ঘটনার বিবরণ দিয়ে ক্যাম্পাসে অবস্থানরত বাকী শিক্ষার্থী ও আশেপাশের মানুষের সহযোগিতা চান। মুহূর্তের মধ্যে ওই ভিডিওটি ফেসবুকে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিওতে ওই শিক্ষার্থীর আশেপাশে আহত শিক্ষার্থীদের চিৎকার ও কান্নার আওয়াজ শুনতে পাওয়া যায়।
পরে রাত সোয়া দুইটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থী বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে উপাচার্য বাসভবনের সামনে গিয়ে শিক্ষার্থীদের উপর হামলাকারী বহিরাগতসহ ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের ধাওয়া দিয়ে ছত্রভঙ্গ করে দেন। এ সময় হামলাকারীদের ছন্নছাড়া হয়ে পালিয়ে যেতে দেখা যায়। পরে সেখানে অবস্থানরত পুলিশের ওপর চড়াও হন বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। এতে আহত হন কয়েকজন পুলিশ সদস্য।
বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাস ও অন্তত ১০ থেকে ১৫ রাউন্ড টিয়ারশেল ছোঁড়ে পুলিশ। এক পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে সেখান থেকে চলে গিয়ে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেন। এ সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত কর্তব্যরত সাংবাদিকদেরও লক্ষ্য করে টিয়ারশেল ছোড়ে পুলিশ। এতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি হিসেবে বিভিন্ন গণমাধ্যমে কর্মরত অন্তত তিনজন সাংবাদিক আহত হন।
এদিন আন্দোলনকারীদের উপর হামলার শুরু থেকেই সাংবাদিকদের ওপর আগ্রাসী আচরণ করতে থাকে হামলাকারীরা। কয়েকবার ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, অস্ত্র নিয়ে চড়াও হওয়াসহ ইটপাটকেল নিয়ে সাংবাদিকদের আক্রমণ করে তারা। হামলাকারীরা উপাচার্যের বাসভবনে ভেতরে ঢোকার আগে ইটপাটকেল ও কাঁচের বোতল ছুঁড়ে ধাওয়া করে উপাচার্যের বাসভবন সংলগ্ন উপ-উপাচার্যের বাসভবনে অবস্থানরত সাংবাদিকদের উপর। পরে সাংবাদিকরা সেখান থেকে সরে যান। এছাড়া হামলা চলাকালে শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ধারালো অস্ত্র নিয়ে একাধিকবার সাংবাদিকদের দিকে তেড়ে যান এবং অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকেন। উপাচার্যের বাসভবনের ভেতরে হামলায় আহত হন সেখানে উপস্থিত একাধিক সাংবাদিক।
রাত সাড়ে তিনটার দিকে ঘটনাস্থলে পুলিশ একটি জলকামান নিয়ে আসে। রাত চারটার দিকে পুলিশ জলকামানসহ সাধারণ শিক্ষার্থীদেরকে ধাওয়া করতে শুরু করে। এরপর তারা বহর নিয়ে শিক্ষার্থীদেরকে লক্ষ্য করে টিয়ারশেল ও ছররা গুলি ছুড়তে থাকে। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় চিকিৎসাকেন্দ্রের সামনে উপস্থিত শিক্ষার্থীদেরকে লক্ষ্য করে একাধিক টিয়ারশেল ছোঁড়ে বলে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী অভিযোগ করেছেন।
ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হামলা ও পুলিশের গুলিতে আহত সাংবাদিকরা হলেন, ‘বণিক বার্তায় কর্মরত মেহদি মামুন, দৈনিক বাংলায় কর্মরত আব্দুর রহমান, বাংলাদেশ টুডেতে কর্মরত জেবায়ের আহমেদ, সময়ের আলোয় কর্মরত মুশফিকুর রিজওয়ান, অনলাইন পোর্টালে কর্মরত সাকিব আহমেদ।
এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক খো. লুৎফুল এলাহীসহ প্রায় দেড়শ শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় চিকিৎসাকেন্দ্রের কর্তব্যরত চিকিৎসক ও প্রত্যক্ষদর্শী। এদের মধ্যে কয়েকজন শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হওয়ার ফলে সাভারের কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
রাত চারটার দিকে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে ঢাকা জেলার পুলিস সুপার মো. আসাদুজ্জামান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন থেকে কল পেয়েই এখানে উপস্থিত হয়েছি। আমার অনেক আগেই পুলিশ ফোর্স এসেছিল। এটা যেহেতু শিক্ষার্থীদের ঝামেলা সেহেতু পুলিশ ঘটনা পর্যবেক্ষণ করছিল। কিছুক্ষণ পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিই আমরা।’
এর আগে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। মিছিলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের সামনে আসলে অতর্কিত হামলা করে ছাত্রলীগ। হামলার বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে রাত সাড়ে ১০টার দিকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নেন আন্দোলনকারীরা।